কুয়েত নিয়ে আর যেটুকু জানি, আজ সবটা বলে দিই।
আমার এক আত্মীয় দাদা দীর্ঘকাল আবুধাবীতে থাকার পর কালজয়ী উক্তি করেছিলেন “আরব দেশে কালচার আর এগ্রিকালচার কোনটাই নেই”। শুনে তখন খুব মজা পেয়েছিলাম। পরবর্তীকালে নিজে কুয়েতের মধ্যে দিয়েই আরবকে খানিকটা বুঝে দাদার ওই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারিনি।
আরব বলতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য মানে ইরান ( প্রাচীন পারস্য ) আর মিশরকেও ধরছি। রাজনৈতিক ভূগোল মহাদেশকে আলাদা করলেও আরব্য রজনী আরবি ভাষায় মিশরীয় সাহিত্য। সে সাহিত্য এতটাই সমৃদ্ধ যে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের অসংখ্য ভাষায় তা অনূদিত হয়েছে, হচ্ছে। আরবের সুফী দর্শণ বর্তমান পৃথিবীতে রীতিমত উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার বিষয়।
ভারতের ইতিহাসে আর্য চেহারার বর্ণনা যা পাওয়া যায়, তা কিন্তু আরব এবং আরবসংলগ্ন পাশ্চাত্য মানে জার্মানীর দিকের মানুষজনের চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। মেসোপটেমিয়া এবং নীল সভ্যতার মত বিশাল বর্ণাঢ্য গৌরবময় ইতিহাস যে জাতির সম্পদ, তাদের কালচার নেই বলি কি করে ! আমি জানিনা বা বুঝিনা সে আমার অজ্ঞতা এবং দীনতা ; জানতে চাইনা, সেটাও আমারই যুক্তিহীন উন্নাসিকতা।
ভারতে বীণা আর এস্রাজ। পাশ্চাত্যে ম্যান্ডোলিন এবং গীটার। আরবে রবাব < রুবেব্। আমরা দাবি করি বীণাই প্রাচীনতম। হতে পারে। বাদ্যের ইতিহাস আমি জানিনা। তবে ধ্বনিগতভাবে রবাব আমার বেশি মধুর লাগে এবং আমার কান বীণা প্রভৃতির সঙ্গে রবাবের কোনই মিল পায়না।
বেলী ড্যান্সকে আমরা যদিও কদর্য ইঙ্গিতবাহী অশ্লীল নাচ বলে মনে করি, ব্যক্তিগতভাবে আমি কিন্তু এই নৃত্যশৈলীতে কোনও অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি। এটা আরবের মুর্খামি এবং দুর্ভাগ্য যে অমন একটি শরীরী ভাষা আজ হোটেল রেস্ট্যুরেন্টের চটুল নৃত্য বলে পরিচিত।
শুধু পেট নয়, দেহের প্রতিটি অঙ্গের অপূর্ব কম্পন এই নাচের মূল বিষয়। তাই সেটা স্পষ্ট বোঝাতে গেলে খোলামেলা পোশাক পরতেই হবে। আরবিরা কিন্তু অভ্যস্ত সংযত আচরণে সপরিবারে এই নৃত্য উপভোগ করেন।
ভেবে দেখুন তো ভারতে দক্ষিণী নৃত্যগুলোর ইতিহাস কি খুব মর্যাদাপূর্ণ ? মন্দিরের চাতালে ঈশ্বরের নামে মানুষকেই তো শরীরী বিভঙ্গে মোহিত করা হত এবং দেবদাসীদের জীবন যথেষ্ট দুঃখের ও অবমাননাকর ছিল। কত্থক একসময় মুঘল দরবারে এবং পরবর্তীকালে বাঈজী প্রথায় সমৃদ্ধি লাভ করে। সে সময় সেই সব নৃত্যশিল্পীদের কিন্তু মোটেও ঘরের বৌ করে নিয়ে আসা হতনা। আরবে নাহয় বিবর্তনটা উল্টো হয়ে গেছে।
গজল নজম সুফি ভারত পাকিস্তানের এই সব নামকরা সঙ্গীতধারার উৎপত্তি সেই আরবেই। শের শায়রী শুনে আমাদের চোখে জল আসে, মুখে তারিফ আসে। সেসব কাব্যকবিতার মূল চর্চাকেন্দ্র আজও সুবিস্তৃত আরব অঞ্চল। আরবিরা উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন আমেরিকা গেলেও পোশাকে খাদ্যাভ্যাসে এবং প্রাত্যহিক জীবনে নিজেদের ঐতিহ্য যাপন করে চলেন।
কৃষি তো নির্ভর করে জল মাটি আবহাওয়ার ওপর। কুয়েতে সুদূর বিস্তৃত দিগন্ত ছোঁয়া মরুক্ষেতে শশা, তরমুজ, খরমুজ আর খেজুরের অনন্ত চাষ। কুয়েতি চাষীরা অত্যন্ত ধনী। বিশেষ ব্যবস্থায় ঢ্যাঁড়স গাজর শাক উচ্ছে ইত্যাদি চাষ করে ইমপোর্টেড সব্জির থেকেও চড়া দামে তাজা সব্জি বিক্রি করেন।
কুয়েত তথা সমগ্র গালফের ডেয়ারী ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। গোসন্তানরা জেনে লজ্জিত হবেন যে কুয়েতের একাধিক ডেয়ারিতে দেখেছি গরুদের জন্য আলাদা আলাদা এসি ঘর এবং সামনে চারণ ক্ষেত্র। প্রত্যহ দুবার গাভীরা নিজেরাই মেশিনের সামনে এসে নিজেদের সেট করে। প্রত্যেকের কাছ থেকে দু’লিটার করে দুধ নিয়ে মেশিন নিজেই থেমে যায়। গোমাতাদের খাওয়ার জন্য বিশেষ উন্নতমানের স্বাস্থ্যকর আলফালফা ঘাস চাষ করা হয়। আহা, আমাদের সুরভি নন্দিনীর দেশের গরু বাঁচাও কমিটি যদি গোমাতাদের এই আদর টুকু করতেন !
মরুভূমিতে বড়ো কষ্ট করে মরূদ্যান বানানো এবং রক্ষা করা হয়। পথের ধারে ধারে তাজা সবুজ ঘাসের ছোট ছোট চোখ জুড়োনো লন আর করবী জাতীয় গাছ আছে। তাদের গোড়া দিয়ে দিয়ে জলের পাইপ এঁকেবেঁকে গেছে। পাইপের গায়ের অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে চব্বিশ ঘন্টা তৃণতরুরা জলসিঞ্চিত হয়। এই জলের ব্যবস্থা হয় সমগ্র দেশেটির প্রাত্যহিক ব্যবহৃত জলের পরিশুদ্ধিকরণের দ্বারা।
কুয়েতের মূল আয় যে সব তেল কোম্পানি থেকে, তাদের সমস্ত কারখানা প্রত্যন্ত বিশাল মরুভূমিতে। ত্রিসীমানায় ঘর বাড়ি দোকান বাজার কিচ্ছু নেই। দুপাশে অনন্ত মরুভূমির বুক চিরে চওড়া মসৃণ পথ বর্ডারে গিয়ে মিশেছে। এই অঞ্চলে গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে থামা বা নামা নিষেধ। মাঝেমাঝে হিংস্র বন্য উট চলে আসায় সুউচ্চ লোহার বেড়াজাল দিয়ে মরুভূমি আর রাস্তাকে আলাদা করা রয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ কুয়েতে এখন পেট্রল ভারতীয় মূল্যে সাড়ে ন টাকা/. লিটার ।
রাজস্থান, ঈজিপ্ট বা দুবাইয়ে মরুভূমি পর্যটকদের ঘোরার জায়গা। তাই মরুভূমির ভয়ানক সৌন্দর্য সেখানে বহুলাংশেই কৌমার্য হারিয়েছে। কুয়েতে চলমান অবস্থায় দেখেছি বেদুইন ইতিবৃত্তের অক্ষত পটভূমি।
মরুবাসের পর আপন দেশে ফিরে অজান্তেই গুনগুন করি :
“মনে হল যেন
পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ
আসিতে তোমার দ্বারে ,
মরুতীর হ’তে সুধা-শ্যামলিম পারে।।”
কুয়েত কথনের শেষ এখানেই …
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
তথ্যদান :
স্বীয় কর্তা ; শ্রী কৌশিক চক্রবর্তী মহাশয়